‘তবুও আমি বেঁচে থাকি, বেঁচে আছি...’-এই কটি শব্দ নিছকই একটি স্মারকগ্রন্থের শিরোনাম নয়; এ এক অজেয় জীবনদর্শনের প্রতিধ্বনি, এক ভালোবাসার চিরন্তন মন্ত্র, যা মোহাম্মদ আনোয়ার নামের এক স্বপ্নদ্রষ্টা মানুষের জীবন ও কর্মকে অবিস্মরণীয় করে তুলবে। পেন্সিল পাবলিকেশনস কর্তৃক প্রকাশিত এই স্মারকগ্রন্থটি কেবল একজন ব্যক্তির প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি নয়, এটি তাঁর কর্মময় জীবনের প্রতিচ্ছবি, তাঁর ভালোবাসার পেন্সিল পরিবার এবং তিনি যে স্বপ্নগুলো বুনেছিলেন, সেগুলোর এক সম্মিলিত জয়গান। উল্লেখ্য, বইয়ের শিরোনামটি মোহাম্মদ আনোয়ারের রচিত ‘এক জোড়া মোজা’ শিরোনামের গল্প থেকে সংগৃহীত।
মোহাম্মদ আনোয়ার ছিলেন অসম্ভব বিনয়ী ও সহজ-সরল একজন মানুষ। যাঁর সান্নিধ্যে যে কেউ মুগ্ধ হতেন। তাঁর উষ্ণ ব্যবহার ও সৃজনশীলতার ছায়ায় অসংখ্য মানুষ তাঁদের প্রতিভার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পেরেছেন। বলা বাহুল্য, তিনি নিজেকে কখনও প্রচার ও অগণিত মানুষের আনতে চাইতেন না; বরং অন্যদের আলোয় নিয়ে আসতেই বেশি ভালোবাসতেন। তরুণ লেখক ও শিল্পীদের তিনি শুধু অনুপ্রাণিতই করেননি, হাতে-কলমে পথ দেখিয়েছেন। বইমেলায় তাঁর বিনয়ী ব্যবহার, অন্যের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের স্বভাব এবং প্রত্যেককে সম্মানিত করার মানসিকতা সকলের মনে স্থায়ী ছাপ ফেলত। তিনি ছিলেন এমন এক পথপ্রদর্শক, যিনি শুধু লিখতে শেখাননি, শিখিয়েছেন নিজের অবস্থান থেকে অন্যের জন্য কিছু করার।
পেন্সিল গ্রুপ এবং পেন্সিল পাবলিকেশনস তাঁর হাত ধরে এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছিল। তাঁর স্বপ্ন ছিল পেন্সিলকে এমন একটি প্ল্যাটফর্মে রূপ দেওয়া, যেখানে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির সব শাখায় গুণী মানুষের সমাবেশ ঘটবে। তিনি বলতেন—‘পেন্সিল এমন একটা প্ল্যাটফর্ম হবে যেখানে সব সুন্দরের সম্মিলন ঘটবে। কেউ হয়ত ছবি আঁকছে; তার সবচেয়ে সুন্দর ছবিটা পেন্সিলে জায়গা পাবে। কেউ হয়ত গান গাইছে; সে পেন্সিলের মাধ্যমে তার গান প্রকাশ করতে পারবে।’ এই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে তিনি নিরলস কাজ করে গেছেন। তাঁর প্রচেষ্টা দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে প্রবাসী লেখক-শিল্পীদেরও পরিচিতি এনে দিয়েছে।
দেশব্যাপী পাঠাগার সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচি ছিল তাঁর আরেক মহৎ চিন্তার প্রকাশ। তিনি বিশ্বাস করতেন, পেন্সিল থেকে নতুন লেখকের বই প্রকাশিত হবে, আর সেই বই পাঠাগারে পৌঁছে যাবে। পাঠাগারে তৈরি হবে নতুন পাঠকসমাজ, যারা আবারও নতুন সৃষ্টিকে অনুপ্রাণিত করবে। এভাবেই গড়ে উঠবে পাঠাভ্যাসের একটি টেকসই বাস্তুসংস্থান এবং একটি সুশিক্ষিত মানবিক সমাজ। এই কর্মসূচি বাস্তবায়নের স্মৃতি আজও রয়ে গেছে রাজশাহীর তানোর উপজেলার মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক প্রতিষ্ঠানে।
তাঁর মহাপ্রস্থানকে কেন্দ্র করে সাজানো এই স্মারকগ্রন্থে একজন নিবেদিতপ্রাণ স্বপ্নবাজ ব্যক্তিত্বের নানা দিক উন্মোচিত হয়েছে। আজিজ ইসলাম তাঁর লেখায় স্মরণ করেছেন মোহাম্মদ আনোয়ারের আন্তরিকতা, বিনয় এবং নতুন লেখকদের প্রতি তাঁর অবিচল উৎসাহের কথা। কীভাবে তিনি লেখকদের পাশে দাঁড়াতেন, তাঁদের লেখালেখির খোঁজ নিতেন, এমনকি বইমেলায় বই কেনার সময়ও তাঁদের উৎসাহ দিতেন—তা অত্যন্ত মর্মস্পর্শীভাবে ধরা পড়েছে। বইমেলায় তিনি যেন হয়ে উঠতেন পেন্সিল ও পেন্সিল লেখকদের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর, যা তাঁর সহজ-সরল ব্যক্তিত্বেরই প্রতিচ্ছবি।
আনোয়ারা আবেদীন তাঁর স্মৃতিচারণে পেন্সিলকে দেখেছেন মোহাম্মদ আনোয়ারের স্বপ্নের প্রতীক হিসেবে, যা মানুষকে স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছে। রাজশাহীতে পেন্সিলের নারী সদস্যদের বৃক্ষরোপণ কর্মসূচিতে তাঁর উদ্ভাবনী চিন্তা—যেখানে বৃক্ষের নীচে ভালো কথা লিখে রাখার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল; তাঁর গভীর দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির সাক্ষ্য বহন করে।
এস এম নিয়াজ মাওলা, আসকার ইবনে ফিরোজ (রুশো), জাহিদ রহমানের লেখায় আমরা পাই বন্ধুরূপে মোহাম্মদ আনোয়ারের বহুমাত্রিক সত্তা। নানা টানাপড়েনের ভেতরেও বন্ধুদের প্রতি তাঁর অদম্য বিশ্বাস ও বন্ধুত্বের উষ্ণতা তাদের লেখায় স্পষ্ট।
তৌহিদা হানফী মাহমুদ তাঁর লেখায় দেখিয়েছেন সন্তানতুল্য এক তরুণের শৈশব-কৈশোরের বিচিত্র স্মৃতি এবং সেই তরুণের সম্মোহনী ক্ষমতার বহুরূপ। মাহরীন ফেরদৌস, মাহফুজা বেগম স্নিগ্ধা, শারমিন রহমানসহ আরও অনেকে তাঁদের লেখায় তুলে ধরেছেন মোহাম্মদ আনোয়ারের সরলতা, বুদ্ধিদীপ্ত চিন্তাভাবনা ও সকলের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসার কথা। মূলত তিনি ছিলেন নীরব, চিন্তাশীল এবং গভীর আবেগমথিত এক সৃজনশীল মানুষ। তাঁর কথায় আবেগ ও গভীরতা মিলেমিশে থাকত।
তাঁর প্রতিষ্ঠিত পেন্সিল কেবল একটি অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ছিল না; অল্প সময়েই এটি পরিণত হয়েছিল একটি সামাজিক আন্দোলনে। সাহিত্য, গান, চিত্রকলার মতো সৃজনশীল সব বিষয় এখানে স্থান পেত। তাঁর নিষ্ঠা, শৃঙ্খলা ও দৃষ্টিভঙ্গির কারণে পেন্সিল অচিরেই হয়ে উঠেছিল একটি গঠনমূলক ও শৃঙ্খলাবদ্ধ সৃজনশীল পরিবার। আজ সমকালীন লেখক, শিল্পী বা ফটোগ্রাফারকে আমরা প্রতিষ্ঠিত হিসেবে চিনি, তাঁদের সাফল্যের পেছনে মোহাম্মদ আনোয়ারের উৎসাহ ও অবদান অনস্বীকার্য। যদিও তিনি কখনও নিজের প্রশংসা চাননি, সত্য হলো, তাঁর সহযোগিতা অসংখ্য প্রতিভাকে বিকাশের সুযোগ করে দিয়েছে।
লুনা নুসরাত-এর মতে, আনোয়ার ছিলেন এক স্বপ্নবাজ তরুণ, যিনি দেশকে নিয়ে গভীরভাবে ভাবতেন। সামাজিক মাধ্যমকে তিনি কেবল আত্মপ্রদর্শনের হাতিয়ার ভাবেননি, বরং দেশের কল্যাণে এর সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর কথা ভেবেছিলেন। তাঁর দেশপ্রেম কেবল মুখে নয়, কাজে প্রতিফলিত হতো।
বিভিন্ন লেখকের স্মৃতিচারণে উন্মোচিত মোহাম্মদ আনোয়ারের এই বিচিত্র রূপ একত্রে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিচ্ছবি নির্মাণ করেছে। ফলে পাঠক এই স্মারকগ্রন্থে আবিষ্কার করতে পারবেন একজন স্বতন্ত্র, নিবেদিতপ্রাণ ও অসাধারণ মানুষকে।
শুধু লেখা নয়, এই গ্রন্থে স্থান পেয়েছে ফটোগ্রাফারদের ছবি। কিছু ক্ষেত্রে ফটোগ্রাফারের নাম উল্লেখ করা গেলেও, কিছু ক্ষেত্রে কেবল সংগ্রাহকের নামই উল্লেখ করা সম্ভব হয়েছে, কেননা মূল দৃশ্যধারণকারীর পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এজন্য যাঁদের নাম উল্লেখ করা যায়নি, তাঁদের প্রতি আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করছি।
আমরা চেষ্টা করেছিলাম ২০২৫ সালের গ্রন্থমেলায় এই স্মারকগ্রন্থটি প্রকাশ করতে। কিন্তু প্রয়োজনীয় লেখা সময়ে সংগ্রহ করতে না পারায় তা সম্ভব হয়নি। এ জন্য পেন্সিলর এবং মোহাম্মদ আনোয়ারের পাঠকশ্রেণির কাছে আমরা ক্ষমাপ্রার্থী।
আজ তিনি শারীরিকভাবে আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু তাঁর স্মৃতি, কর্ম ও আন্তরিকতা আমাদের হৃদয়ে চিরস্থায়ী। মোহাম্মদ আনোয়ারের মতো মানুষ দেহগতভাবে প্রস্থান করলেও হারিয়ে যান না; তাঁরা থেকে যান মানুষের ভালোবাসায়, থেকে যান মহাকালের প্রদর্শক হয়ে। তাঁর সৃজনশীলতা, চিন্তাভাবনা ও বিনয় আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে থাকবে। এই স্মারকগ্রন্থ সেই প্রমাণ—যে ভালোবাসা ও কর্মের মাধ্যমে একজন মানুষ কীভাবে চিরঞ্জীব হয়ে থাকেন। যিনি স্বপ্ন দিয়ে অসংখ্য জীবনের ভিত গড়েছেন, তিনি থাকবেন আমাদের অনুপ্রেরণার স্থায়ী ঠিকানায়। এটি কেবল একটি স্মরণ নয়; বরং তাঁর রেখে যাওয়া স্বপ্নের পথে হাঁটার এক অবিরাম প্রেরণা, যা পেন্সিল পরিবারকে সম্মুখে এগিয়ে নেবে।
আমরা আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই প্রজ্ঞাবান শিল্পী সোমনাথ ঘোষকে। যিনি তাঁর নিমগ্ন সৃষ্টিতে সাজিয়েছেন মোহাম্মদ আনোয়ারের স্মারকগ্রন্থের নান্দনিক প্রচ্ছদ। এর পাশাপাশি ধন্যবাদ জানাই সেইসব পেন্সিলরকে, যাঁরা নিরন্তরভাবে মোহাম্মদ আনোয়ারের জীবন ও কর্মকে ঘিরে পেন্সিলকে সৃজনশীল মানুষের একটি সম্মিলিত সত্তায় পরিণত করতে অবদান রেখে যাচ্ছেন।
আমরা বিশ্বাস করি, মোহাম্মদ আনোয়ারকে নিবেদিত এই স্মারকগ্রন্থ তাঁর অগণিত ভক্ত, লেখক ও শিল্পীর মনে তাঁর স্মৃতিকে অম্লান রাখবে এবং তাঁর স্বপ্নগুলো বাস্তবায়নে তাঁদের নতুন করে অনুপ্রাণিত করবে।