পংকজ পাল একজন সমকালীন বাংলা কবি, যাঁর কবিতায় ধরা পড়ে সময়, সমাজ ও মানুষের নিঃশব্দ যন্ত্রণার প্রতিচ্ছবি। ভাষার গভীরে ডুব দিয়ে তিনি খোঁজেন আত্মপরিচয়ের মানচিত্র, যেখানে ভালোবাসা, প্রতিবাদ ও নিঃসঙ্গতা পরস্পরকে ছুঁয়ে থাকে।
‘চন্দ্রবতীর অগ্নিস্নান’ রূপক, চিত্রকল্পময়তার অপূর্ব এক সন্নিবেশন হয়েছে। যেমন এখানে কবি ভূগোলের এই যাপিত জীবনকে এক অনন্য উচ্চতায় তুলে ধরেছেন— ‘ঝিমন্ত এই করাতঘরে বোন,/ এক ফোঁটা আলো দাও—/ঝরঝরিয়ে পড়ে যাক তারার গুঁড়ো,/ আমরা তাতে রুটি সেঁকব চুপিসারে। আবার পরক্ষণেই তিনি বলেছেন— কুঁকড়ে আছে পিঁপড়ের দল/ বাতাসে শুকনো ধানের গন্ধে,/ হাতের তালুতে যদি একমুঠো ভাত পায়/ তবেই তারা রাতটুকু স্বপ্নে কাটায়।
এই যে মানুষের যাপিত জীবনের লালন করা স্বপ্ন, আর এই স্বপ্ন আছে বলেই মানুষে মানুষে জীয়নকাঠির মতো স্বপ্ন আর বাস্তবের দোলাচালে চাঁদ দোল খায়। আকাশ কখনো কখনো গোপন গুহা হয়ে যায়— আকাশ এখন গোপন গুহা,/ চাঁদ তার ভাঙা থালায় ভিক্ষা তোলে;/ শালবনের মাটিতে সাপের খোলস ঝরে পড়ে,/ আমরা তাতেই বানাই ঝাণ্ডা—/ লাল, উষ্ণ, কাঁপতে থাকা রক্তের মতো।
মানুষ মাটি থেকে উত্থিত হয়েছে— আবার মাটিতেই মিশে যাবে। এই যে দোল খাওয়া জীবনের দ্যোতনা— সেই একই ব্যঞ্জনা যেখানে যাপিত জীবনের ব্যবহার্য জিনিষপত্র আগুনে পুড়িয়ে খাঁটি করা হয়, সেই আগুনেই মানুষের চিতাভষ্ম হয়। বাজে না কোনো শিঙা, বাজে না দামামা,/ কিন্তু নদীর গর্ভে শোনা যায়/ মাটির কুমোরদের অনন্ত স্লোগান—/ যে আগুনে হাঁড়ি পোড়ে,/ সে আগুনেই মানুষ গড়ে।
কবি পংকজ পাল নানা মাত্রিক বোধর মিশ্রণে চিত্রকল্পময় এক অনুপম সৌকর্যের জমিন রচনা করেছেন এই কবিতাগ্রন্থে। একদিন শীতের হিমেল রাতে চন্দ্রাবতী মৃত্যুর স্বাদ নিতে বেঁচে থাকার পথেই পা বাড়ায়— একদিন হিমেল রাতে/ চন্দ্রাবতী কাঁধে তুলে নিল শুকনো খড়ের মশাল,/ মা বলল— ফিরে এসো বাছা, এ পথে মৃত্যু/ সে হেসে বলল— মৃত্যুই যদি বেঁচে থাকা শেখায়, তবে যাই।
‘চন্দ্রবতীর অগ্নিস্নান’ এক অনিন্দ্য সুন্দর চিত্রপটে আঁকা কাব্যময়তায় মূর্ত হয়ে ওঠা কবিতাগ্রন্থ। এখানে রূপক, চিত্রকল্প নানা মাত্রিক বোধের মিশ্রণে উদ্ভাসিত হয়েছে। নিশ্চয় পাঠকের ভালো লাগবে, আনন্দের বারতা খুঁজে পাবেন।
আনোয়ার কামাল
কবি, গল্পকার, প্রাবন্ধিক ও সাহিত্য আলোচক
সম্পাদক-প্রকাশক—‘এবং মানুষ’
ঢাকা।