বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়েও পরাবাস্তবের দুনিয়ার প্রতি মানুষের আগ্রহ চিরন্তন। সে-আগ্রহে বিশ্বাসী-অবিশ্বাসীর ভেদ নেই। ও-জগৎ আধ্যাত্মিকতায় আহ্বান করে বিশ্বাসীকে আর অজানা কাহিনির হাতছানি দেয় অবিশ্বাসীকে।
পরাবাস্তবের জগৎ আছে কি নেই, এ তর্কটি বোধ করি মানুষের জগৎবোধের মতোই প্রাচীন এবং বাস্তবজগতের মতোই অটল। আজও সে-তর্কের সমাধান হয়নি। তবে মানুষের অনুসন্ধিৎসা তর্কের সমাধানের তোয়াক্কা করে কমই। তাই বাস্তবজগতের সীমানা ছাড়িয়ে পরাবাস্তবের সন্ধানে মানুষের উদ্যম ইতিহাসের ধারা বেয়ে আজও প্রবহমান।
সে-উদ্যমধারাটি দেশ-কাল-জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে দুনিয়ার সমস্ত কোণেই লক্ষ করা যায়, লক্ষ করা যায় তীব্র অনুসন্ধিৎসু মানুষ— যাঁরা ছায়াময় অজানা জগতের পরদা তুলে ঝাঁকিদর্শনের প্রচেষ্টা করে চলেছেন দীর্ঘ সময় ধরে।
শ্রী দীপঙ্কর মুখোপাধ্যায় তেমনই একজন মানুষ। জীবনের বাহ্যিক যাপনে তাঁর চলাচল বাস্তবের ভিত্তিভূমিতেই দৃঢ়সংলগ্ন। ভারত সরকারের উচ্চপদস্থ আমলা হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন প্রেসিডেন্সি কলেজের এই প্রাক্তনী। শাসকীয় ব্যবস্থার অন্দরমহলে দীর্ঘসময় কাটানো মানুষের পক্ষে যেমনটি স্বাভাবিক, শ্রী মুখোপাধ্যায়ের কর্মজীবনটিও দেশে-বিদেশে নানা কর্মকাণ্ডে ছিল তেমনটি মুখর, চেনা-জানা পৃথিবীর রূপ-রস-বর্ণে তেমনটিই সমুজ্জ্বল। সে-জীবনের একটি বড়ো মনোগ্রাহী আলেখ্য ধরা রয়েছে ইতিপূর্বে প্রকাশিত তাঁর আত্মজীবনীতে।
কিন্তু শ্রী মুখোপাধ্যায়ের জীবনের আত্মিক যাপনের একটি বড়ো অংশের সঙ্গে জড়িত রয়েছে পরাবাস্তব ও অতিলৌকিকের নিবিড় সন্ধান। ব্যবহারিক জীবনের প্রাত্যহিকতার গোলকধাঁধায় বারংবার পরাবাস্তবের সে-ছায়াময় জগৎটি তাঁর অস্তিত্বে ইঙ্গিতবহ রেখাপাত করে গিয়েছে। সে-ইঙ্গিত কখনও এসেছে অযাচিত স্বাভাবিকতায় আবার কখনও বা তার চিহ্ন পরিস্ফুট হয়েছে সুনির্দিষ্ট উদ্যোগে। অলৌকিকের সঙ্গে তাঁর সে-দীর্ঘ পরিচয়ের কথা আংশিকভাবে নিজের আত্মকথায় সংযোজিত করেছেন লেখক।
কিন্তু বর্তমান গ্রন্থটি বিষয়ে ও ধরনে একেবারেই ভিন্ন। এ-গ্রন্থটি অলৌকিক বিষয়ে লেখকের আজীবন অভিজ্ঞতার স্মৃতিআলেখ্যই শুধু নয়, এক মানুষের আত্মানুসন্ধানের হৃদয়গ্রাহী কাহিনিও বটে।
মননশীল, প্রতিষ্ঠিত পরিবারের সন্তান শ্রী মুখোপাধ্যায়। জীবনের প্রথম থেকেই তাঁকে ঘিরে ছিল সংস্কৃতি ও পাঠচর্চা। সে-কৃষ্টিযাপনের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গও হয়তো ছিল আধ্যাত্মিকতা। তাই ছোটোবেলা থেকেই লেখকের মনোজগৎ ও যাপনজগতের দুয়ারে বারেবারে কড়াখাত করেছে পরাবাস্তবের কুহেলিকাময় অস্ত্বিত্ব।
এ গ্রন্থে সেই বাল্যকালের উচ্ছল দিনগুলি থেকে শুরু করে আজ পরিণত বয়সের শান্ত-স্থিরতার যাত্রাপথটিতে লেখক বারংবার তাই সাড়া দিয়েছেন সে অস্পষ্ট হাতছানিতে, দুই জগতের মাঝের অনচ্ছ পরদাটিকে সরিয়ে, দেখতে চেয়েছেন অজানার স্বরূপ।
শ্রী মুখোপাধ্যায় বাঙালির এক অধুনাবিস্মৃত প্রজন্মের সন্তান। যে-প্রজন্মের মানুষ বোধ ও চেতনার দ্বারটি খুলে রাখত অজানাকে জানার আগ্রহে, ভ্রম-ভীতিতে বন্ধ করে রাখত না মনোজগতের পথ— সেই প্রজন্মের। তাই সুপণ্ডিত মানুষটির আগ্রহের বিষয়বস্তু বহু ও বিচিত্র। কর্মজীবনের ব্যস্ততার মধ্যেও শ্রী মুখোপাধ্যায় কলম নামিয়ে রাখেননি কখনও, রচনা করেছেন একাধিক গ্রন্থ। রাজনীতি ও ইতিহাস সম্পর্কিত সে-গ্রন্থগুলি আশ্চর্য রকমের সুখপাঠ্য ও অন্তর্দৃষ্টিতে উজ্জ্বল।
তবে একটি কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়— ‘প্রেতকথন ও অন্যান্য অতিলৌকিক প্রসঙ্গ’ গ্রন্থটি লেখকের সৃষ্টিগুলির মধ্যে অন্যতম একটি শ্রেষ্ঠ স্থান অধিকারের দাবিদার। এ গ্রন্থে লেখকের কলমের স্বচ্ছন্দচলনে মিশেছে তাঁর জীবনব্যাপী অন্বেষণ ও ব্যক্তিগত উপলব্ধির নির্যাস। তাই এই মিতায়তন গ্রন্থটি শুধু এক পরাবাস্তব-উৎসাহীর অভিজ্ঞতালিপিই নয়, বরং ব্যক্তিমানুষের অন্তর্লীন যাপন ও আধ্যাত্মিক যাত্রাপথের এক অনন্য কথামালা।
শ্রী মুখোপাধ্যায়ের লেখার সঙ্গে যাঁরা ইতিমধ্যেই পরিচিত, তাঁরা জানেন, লেখকের কলমে রয়েছে এক স্বাভাবিক রসধারা; এই বইতেও পাঠকদের সে-রসাস্বাদনের প্রভূত সুযোগ রয়েছে, তা প্রথম পাঠেই বোঝা যায়। লেখকের কলমে, এ লেখায় রয়েছে হালকা বৈঠকি চালের একটি মেজাজি ধাত, যা পাঠককে একটিবারের জন্যও বিমুখ করবে না— এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
তবে সর্বোপরি এ গ্রন্থটি এক আখ্যানবিশেষ। এক পথিকের আখ্যান, এক অন্বেষকের আখ্যান এবং এক সুরসিক মানুষের অনন্যসাধারণ জীবনের আখ্যান। স্মৃতিকথায় এমন কথকতার মৌজ আনতে পারা কম কথা নয়। পাঠক হিসেবে তাই আমাদের একটি আক্ষেপ বরাবরই থাকবে— কেন যে শ্রী দীপঙ্কর মুখোপাধ্যায়ের কলম অধিকপ্রসবী হল না!
পাঠক, আসুন, আর বাক্যব্যয়ে কালক্ষেপ না করে আমরা পরাবাস্তবের এক অতুলনীয় স্মৃতিধারায় অবগাহন করি।