২১শ শতকের বিশ্ব এক জটিল, বহুস্তরীয় এবং দুর্বোধ্য নিরাপত্তা বাস্তবতার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে, যেখানে 'জাতীয় নিরাপত্তা'—শব্দটি আর কেবল সীমান্ত রক্ষার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই; বরং এটি এক বহুমাত্রিক ধারণা, যা রাষ্ট্রের অস্তিত্ব, সার্বভৌমত্ব, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, সাইবার পরিসর, অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা এবং জনমনস্তত্ত্ব পর্যন্ত বিস্তৃত। একবিংশ শতাব্দীর ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা, আন্তঃরাষ্ট্রীয় দ্বন্দ্ব, গোয়েন্দা যুদ্ধ, অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্র এবং আঞ্চলিক আধিপত্যবাদী প্রবণতার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের মতো একটি ভূকৌশলগতভাবে সংবেদনশীল রাষ্ট্রের জন্য জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়টি এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় এজেন্ডাগুলোর একটি হয়ে উঠেছে।
এই গ্রন্থটি—“ জাতীয়নিরাপত্তাবাংলাদেশ প্রেক্ষিত”—জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ে একটি সমন্বিত ও বিশ্লেষণধর্মী চিন্তা-পরিক্রমা উপস্থাপন করার প্রয়াস। এতে অন্তর্ভুক্ত প্রতিটি প্রবন্ধ বা নিবন্ধ বাস্তব অভিজ্ঞতা, নীতিগত বিশ্লেষণ, তথ্যনির্ভর মূল্যায়ন এবং আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক প্রেক্ষাপটের আলোকে রচিত। বাংলাদেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা, সামরিক আধুনিকায়ন, জাতীয় ঐক্য, গোয়েন্দা অনুপ্রবেশ, এবং বহিরাগত হুমকি—এসব বিষয়ের সামগ্রিক অবয়ব এই গ্রন্থে আলোকপাত পেয়েছে।
এই সংকলনের প্রবন্ধগুলো বিভিন্ন সময় দেশি-বিদেশি জার্নাল, সংবাদপত্র এবং বিশেষায়িত সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিটি প্রবন্ধ বর্তমান বাস্তবতা এবং ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় একটি বুদ্ধিবৃত্তিক ও নীতিনির্ধারক সংলাপ সৃষ্টি করতে সক্ষম। পাঠকের সামনে উপস্থাপিত হয়েছে— কেন জাতীয় নিরাপত্তা এখন কেবল বাহ্যিক সামরিক হুমকি নয়, বরং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, কৌশলগত এবং মনস্তাত্ত্বিক পর্যায়েও এক জটিল প্রক্রিয়া; কীভাবে বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থা, বিশেষত ভারতের RAW, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক প্রভাব, প্রযুক্তিগত অনুপ্রবেশ এবং তথ্য সংগ্রহের মাধ্যমে একটি ছায়া শাসনের কাঠামো তৈরি করেছে; এবং কেন রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, গোয়েন্দা কাঠামো এবং কূটনৈতিক নীতিতে একটি ব্যাপক সংস্কার সময়ের দাবি হয়ে উঠেছে।
রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট, ফেনী করিডোর, মিরসরাইয়ে ভারতীয় অর্থনৈতিক অঞ্চল, কিংবা মানবিক করিডোরের আড়ালে কৌশলগত ভূ-অভিসন্ধি—প্রবন্ধগুলোতে এসব ইস্যুর অন্তর্নিহিত নিরাপত্তা ও ভূরাজনৈতিক জটিলতা অত্যন্ত গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। পাশাপাশি, ‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’ বা ‘অদৃশ্য যুদ্ধের ছায়া’ নামক বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক গোয়েন্দা কর্মকাণ্ড থেকে বাংলাদেশের জন্য প্রাপ্ত শিক্ষার দিকগুলোও এই গ্রন্থে উঠে এসেছে।
গ্রন্থটির উদ্দেশ্য কেবল জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ে সতর্কতা জাগানো নয়—বরং একটি রূপান্তরধর্মী নিরাপত্তা চেতনা গড়ে তোলা, যেখানে রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তর—প্রশাসন, সেনাবাহিনী, কূটনীতি, বুদ্ধিজীবী সমাজ ও নাগরিকগণ—একে অপরের পরিপূরক হয়ে কাজ করবে। একটি আত্মনির্ভর, প্রযুক্তিনির্ভর, কৌশলগতভাবে স্বনির্ভর, এবং বহুমাত্রিক নিরাপত্তাব্যবস্থায় সুসংহত রাষ্ট্র গঠনের দিশা দেখাতেই এই গ্রন্থের প্রয়াস।
“জাতীয় নিরাপত্তা বাংলাদেশ প্রেক্ষিত” শুধুমাত্র একজন বিশ্লেষকের কলমে লেখা তথ্যনিবদ্ধ নিবন্ধের সংকলন নয়—এটি এক সজাগ জাতির চেতনার আয়না। এটি রাষ্ট্র পরিচালনাকারীদের জন্য কৌশলগত দিকনির্দেশনা, শিক্ষার্থীদের জন্য গবেষণার উৎস, এবং সাধারণ পাঠকের জন্য সচেতনতা বৃদ্ধির পথনির্দেশ।
এই গ্রন্থের প্রতিটি প্রবন্ধ একটি আহ্বান—জাতির নিরাপত্তা, আত্মমর্যাদা ও স্বাধীনতার পক্ষে ঐক্যবদ্ধ হবার। যখন রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা কাঠামো শুধু বাহ্যিক অস্ত্র নয়, বরং অভ্যন্তরীণ ঐক্য, প্রযুক্তি-নির্ভরতা ও তথ্য-সচেতনতায় গড়ে ওঠে—তখনই একটি জাতি সত্যিকার অর্থে নিরাপদ থাকে। এই গ্রন্থ সেই নিরাপত্তাবোধের বীজ বপনের একটি ক্ষুদ্র, কিন্তু দৃঢ় পদক্ষেপ।184